Ameen Qudir
Published:2019-02-19 07:48:10 BdST
শোক এপিটাফআপোষকামি মানুষের কাছে জীবন এমনিতেই ক্লান্তিকর: তিনি সেই ক্লান্তি থেকে মুক্তি পেয়েছেন
ডা. গুলজার হোসেন উজ্জ্বল
___________________________
ছোট বেলায় আব্বা বলেছিলেন আল মাহমুদ অনেক বড় কবি। তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার লোক। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সন্তান হিসেবে তাকে নিয়ে আমার গর্ব বোধ করা উচিত৷ শুনে আমি গর্ব বোধ করা শুরু করলাম। মূলত সেখান থেকেই আল মাহমুদকে চেনা।
পাঠ্য বইয়ে তাঁর কিছু কবিতা পড়েছিলাম। তার মধ্যে একটি ছিল "পাখির কাছে ফুলের কাছে"। সেই কবিতায় তিনি চাঁদকে ডাবের সাথে তুলনা করেছিলেন। ডাবের মত চাঁদ উঠেছে ঠান্ডা গোলগাল। কবিতাটা পড়ার পর একটা শীতল অনুভব হয়েছিল।
ক্লাস টেনে পড়ার সময় 'নোলক' কবিতাটা আবৃত্তিকার, অভিনেতা গোলাম মুস্তাফার কন্ঠে শুনি। গায়ে কাঁটা দিয়েছিল।
একটু বড় হবার পর তার 'জলবেশ্যা' গল্পটি পড়ি। গল্পটি বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্র থেকে প্রকাশিত বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ গল্পের সংকলনে ছিল। অসাধারণ একটা গল্প। তবে সেই সদ্য কৈশোর পেরুনো বয়সে গল্পের শিল্পগুনের চেয়ে তার কামগন্ধময় সরস বর্ণনা আমাকে শিহরিত করেছিল বেশি। শুধু আমাকেই না বয়েজ হোস্টেলের সবাইকে। তিন খন্ডের সংকলন ছিল সেটা। কিন্তু অন্যান্য খন্ডের চেয়ে 'জলবেশ্যা' গল্পটি যে খন্ডে ছিল সেই খন্ডটি হোস্টেলের রুমে রুমে ঘুরতে শুরু করল। পুরো বই এক রকম। দেখা গেল শুধু 'জলবেশ্যা'র অংশটি অতিপঠনে জীর্ণ, মলিন হয়ে গেল। আমার বন্ধুরা খুব আগ্রহ নিয়ে ঐ গল্পটাই পড়েছে৷ অস্বীকার করবনা আমিও অনেকবার পড়েছি।
পরিণত বয়সে জলবেশ্যা আবার পড়েছি। যে শিল্পীত ভংগিমায় আল মাহমুদ নারীর নগ্ন শরীরের বর্ণনা করেছেন তা কেবল একজন মহৎ শিল্পীর পক্ষেই সম্ভব৷
নারীর তলপেটের নিচের অংশটিকে বলেছিলেন ' কৃষ্ণ ব-দ্বীপ' । কি অসাধারণ শব্দ চয়ন!
এরপর একটি গল্প পড়েছিলাম নাম মনে করতে পারছিনা। সেই গল্পটিতে তিনি একজন বিধবা পুত্রবধুর সাথে বিপত্নীক শ্বশুরের শারীরিক সম্পর্ককে অত্যন্ত যৌক্তিক, শিল্পীত ও মানবিক দৃষ্টি ভংগিতে উপস্থাপন করেছিলেন। বলার অপেক্ষা রাখেনা আমি যারপরনাই মূগ্ধ হয়েছিলাম তাঁর সেই সাহসিকতায়।
আমার কেবলই মনে হয়েছিল আমাদের গদ্য সাহিত্যে তাঁর অনেক কিছু দেবার ছিল।
তো এই সাহসী কবি ও লেখক জীবনের কোন এক পর্যায়ে আল্লাহপাকের হেদায়েত প্রাপ্ত হন। ইসলামী ছাত্র শিবিরের বা জামায়াতে ইসলামের কোন এক সভায় উনি বললেন "আমি একসময় গনকন্ঠের সম্পাদক ছিলাম। সমাজতন্ত্র কায়েম করতে চেয়েছিলাম। অথচ কি আশ্চর্য আমার মধ্যে কি হলো আমি আজ আল্লাহ পাকের দ্বীনের পথে নিজেকে উৎসর্গ করেছি। এর চেয়ে বড় মোজেজা আর কি হতে পারে! "
তিনি হেদায়েত প্রাপ্ত হতেই পারেন। কিন্তু দ্বীনের পথে আসার পরও তিনি নারী শরীরের সরস বর্ণনা দেওয়া 'জলবেশ্যা' গল্পটি নিয়ে বেশ গর্ব অনুভব করেছেন। কিংবা তার এইরূপ অপরাপর গল্প কবিতা নিয়েও আফসোস করেননি। নায়িকা শাবানাও হেদায়েত লাভের পর তার হেদায়েতপূর্ব জীবনের অভিনীত সিনেমা নিয়ে অনুতাপ প্রকাশ করেছেন। চ্যানেলগুলোকে অনুরোধ করেছেন এসব প্রচার না করতে। (যদিও পুরস্কার নিতে কুন্ঠা করেননি।)
তবে আল মাহমুদ তাও করেননি। তিনি একই সাথে তার বেশরীয়তী গল্প উপন্যাস নিয়ে গর্ব অনুভব করেছেন। সুবিধাও নিয়েছেন। কলকাতায় জলবেশ্যা নিয়ে সিনামা হয়েছে। একজন হেদায়াতপ্রাপ্ত রূহানী জগতের মানুষ হয়েও তিনি সিনেমা বানানোয় অনুমতি দিয়েছেন। বিভিন্ন সাক্ষাতকারে তিনি গর্ব করে বলেছেন ওপার বাংলায় তার অনেক মূল্যায়ন।
আল মাহমুদের মূল সমস্যাটা এখানেই। মানুষ হিসেবে তিনি খুব দুর্বল চরিত্রের। ব্যক্তিত্বহীন সুবিধাভোগী৷ কবিরা ব্যক্তিত্বহীন হলে ভক্তি থাকেনা৷ তার সুন্দরতম কবিতাও তখন উপহাস করতে থাকে। এরকম ব্যক্তিত্বহীন সুবধাভোগী কবি এইদেশে আর কেউ ছিলনা এমন না। ছিল, আছে। তবে এই গুনে উনার ধারে কাছে কম লোকই আছে।
মুক্তিযোদ্ধা না হয়েও তিনি নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা দাবী করেছেন। কবি হবার জন্য মুক্তিযোদ্ধা হওয়াটা জরুরি না। তিনি মুক্তিযোদ্ধা না হলেও চলত। শামসুর রাহমান মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন না৷ আরো অনেকেই ছিলেন না। কিন্তু তারা নিজেদের মুক্তিযোদ্ধা বলে দাবীও করেন নাই। আল মাহমুদ তার নিজের আত্মজীবনীতেই লিখেছেন যে তিনি যুদ্ধের এক পর্যায়ে কলকাতায় পালিয়ে যান। সেখানে গিয়ে বাসার বাইরে বের হতেন না। কারণ শহরের কিছু চেনেন না। তার ভয় করতো যদি হারিয়ে যান। সেই তিনি নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা বলে দাবী করা শুরু করলেন।
তার কাছে গোলাম আজম ছিল সমকালের সবচেয়ে প্রজ্ঞাবান রাজনীতিবিদ। শিবির সবচেয়ে ঈমানদার সংগঠন। তা তিনি ভাবতেই পারেন৷ কিন্তু মুশকিল হলো বাংলাদেশে তিনিই একমাত্র কবি যিনি একই সাথে মুক্তিযুদ্ধ এবং গোলাম আজমের প্রতিভা দুটোরই সমান সমঝদার। ফলে তার পাঠকদের হয়েছে বিপদ। কোন দিকে যাব?
এরকম ব্যক্তিত্বহীন দুর্বল লোককে কেউ অপছন্দ করতেই পারে৷ করলে তাকে দোষ দেওয়া যায় না। কেউ যদি তার কবিতাকে বাংলা সাহিত্যের জন্য অনিবার্য মনে না করে, নাইবা করল? সমস্যা হলো আল মাহমুদের মুরিদানরা এটা মানতে চাইছেন না। তারা চান আল মাহমুদের জন্য শোক প্রকাশ করতে হবে৷ এমনকি তিনি যে কবি হিসেবে যথেষ্ট দাপুটে ছিলেন না এটাকে তারা মানতে পারছেন না৷ তার কোন সমালোচনা করা যাবেনা৷ মৃত মানুষ সমালোচনার উর্ধে। তাহলে তো মীরজাফরেরও সমালোচনা করা চলেনা। কারণ মীরজাফরও মৃত।
আল মাহমুদের ভক্ত আশেকানরা আরেকটা কথা বলেন। কথাটা হলো রাষ্ট্রের কাছে তিনি যোগ্য মূল্যায়ন পাননাই৷ আল মাহমুদ একুশে পদক পেয়েছেন সেই ১৯৮৬ সালে। বনানীতে সরকারি বরাদ্দের জমি পেয়েছেন। সেখানে বাড়ি করবার জন্য সহজ শর্তে ঋণও পেয়েছেন। শিল্পকলা একাডেমির পরিচালক ছিলেন। অর্থাৎ রাষ্ট্রের কাছে পাওয়া সম্ভব এমন প্রায় সবই পেয়েছেন।
কেউ কেউ বলেন কবিগণ দল মতের উর্দ্ধে। যিনি নিজেই দলমতের উর্ধে উঠতে চান নাই তাকে জোর করে উর্ধে তুলে দেবার চেষ্টা করার কি মানে আছে?
নবীর চাচা আবু তালেব একজন বড় মাপের কবি ছিলেন৷ তিনি শুধু কবিই নন একজন বড় মাপের মানুষ ছিলেন। নবী একমাত্র তার প্রশ্রয়ের কারণেই মক্কায় অক্ষত ছিলেন। দুর্ধর্ষ কুরাইশদের বাপ দাদার ধর্মের বিপরীতে নতুন ধর্মমত চালায়ে গেছেন দশ বছর। আজকের মক্কায় কেউ এরকম করে দেখুক কল্লা থাকবেনা৷ তো সেই আবু তালেব মারা যাবার সময় নবি তাকে শেষ বারের মত হেদায়েত করতে চেয়েছিলেন৷ তিনি হন নাই। তিনি নিজে যে মতবাদ গ্রহণ করেন নাই, কেউ যেন সেই মতবাদ নির্বিঘ্নে প্রচার করতে পারেন তার সব ব্যবস্থা করেছেন। এরচেয়ে মহৎ মনুষ্যত্বের উদাহরণ আর কি হতে পারে? সেই আবু তালেব বেহেশত পেলেননা। নবী আফসোস করে বলেছিলেন তার আর বেহেশতে যাওয়ার সুযোগ রইলনা৷ শুধু যে বেহেস্ত মিস করেছেন তা নয়, আবু তালেবের কবি পরিচয়ও হারিয়ে গেছে। মতাদর্শের জটিলতায় তিনি ইতিহাসের নায়ক হতে পারেন নাই। এমনকি তার কবি পরিচয়টাও হারায়ে গেছে৷ যারা ভাবছেন মতাদর্শ বড় নয় কবিত্বই বড় তারা এই ইতিহাসটাকে ভেবে দেখতে পারেন৷
আল মাহমুদকে মৃত্যুর পর শহীদ মিনারে নেওয়া হবে কিনা তা নিয়ে বেশ একটা ক্যাচাল হলো। তিনি যেতে চেয়েছেন কি? তিনি যে তরীকার বায়াত নিয়েছিলেন সেই তরীকায় তার গুরুরা কেউই শহীদ মিনারকে খুব একটা ইজ্জতের জায়গা বলে মনে করেননাই। শহীদ মিনারে ফুল দেওয়াটাকে তারা এক প্রকারের শেরেক বলে মনে করেন৷ সেখানে আল মাহমুদকে নিয়ে গিয়ে তার আত্মার কোন সদগতিটা হবে? এর চেয়ে মগবাজারের কাজী অফিস লেন জামে মসজিদ বা বায়তুল মোকাররমে তার জানাজা পড়ালে তার বেহেস্তের পথ সুগম হয়।
আল মাহমুদের কবি হিসেবে মৃত্যু হয়েছে আগেই। বরং নানা সাক্ষাতকারে আমার মনে হয়েছে তিনি নিজেই এই জীবন বয়ে নিতে পারছেননা। নানারকম ক্লান্তি ভর করেছে। আমি তার মৃত্যুতে আনন্দিত নই। শোকার্তও নই। তার প্রতি আমার ঘৃণা নেই। করুনা থাকতে পারে। একজন আপোষকামি মানুষের কাছে জীবন এমনিতেই ক্লান্তিকর। তিনি সেই ক্লান্তি থেকে মুক্তি পেয়েছেন৷
____________________
ডা. গুলজার হোসেন উজ্জ্বল । সুলেখক। সঙ্গীত শিল্পী।
আপনার মতামত দিন: