SAHA ANTAR

Published:
2021-03-16 17:06:49 BdST

আদি যুগের অপরাধ: বাইবেল,পুরাণ, গ্রীক উপকথার নানা কাহিনি


 

 অন্তর সাহা 

সহযোগী সম্পাদক,

ডাক্তার প্রতিদিন,কলকাতা 

--------------------------

অপরাধ এবং পারিবারিক এই কেচ্ছা নতুন কিছু নয় ৷ সব দেশের সব যুগেই ফিরে ফিরে এসেছে এই সব কাহিনি৷
অ্যাডম -ইভ বলা হয় থাকে ঈশ্বরের পুত্র-কন্যা হল অ্যাডম আর ইভ৷ বাইবেলের ওল্ড টেস্টামেন্ট অনুসারে, স্বর্গে, ঈশ্বরের বাগানে ছিলেন অ্যাডাম এবং তারই নাকি বুকের পাঁজরের হাড় থেকে সৃষ্টি হয়েছিল ইভ ৷ ঈশ্বরের নির্দেশ ছিল, স্বর্গের উদ্যানের জ্ঞানবৃক্ষের ফল যেন তারা না খায়৷ অথচ ইভ নাকি সেই জ্ঞানবৃক্ষের আপেল খেতে দিয়েছিল অ্যাডামকে ৷ এরফলে তাদের স্বর্গরাজ্য থেকে নির্বাসন দেওয়া হয় ৷ তখন মর্ত্যে নেমে নিজের শরীরপ্রসূত ইভের সঙ্গে সহবাসে লিপ্ত হয় অ্যাডম৷ আর তার থেকেই তো এই মানবজাতি সৃষ্টি বলে কথিত ৷ তাছাড়া , ঈশ্বরও নাকি তাঁদের নির্দেশই দিয়েছিলেন , মর্ত্যে গিয়ে, নিজেদের সংখ্যা বাড়াতে ৷ এখন এঁরাই যদি হবেন মানবজাতির আদি ও একমাত্র জনক -জননী তাহলে তো স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন ওঠে – অ্যাডম ইভের সন্ততিরাই পরস্পরের সঙ্গে মিলনে আবদ্ধ হয়েছিলেন কি না ? যদিও অনেকের ধারণা , সৃষ্টির আদি পর্বে মানুষের অস্তিত্ব বাঁচাতে এই অজাচারকে আদৌ পাপ বলে গণ্য করা হত না ৷ কিন্ত্ত পরবর্তীকালে গোষ্ঠী, সমাজ গড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে এমন অজাচারকে নিষিদ্ধ করা হয়৷
কেইন- অ্যাবেল- আওয়ান এদিকে আবার অ্যাডাম -ইভের ছিল দুই পুত্র – কেইন এবং অ্যাবেল৷ কেইন চাষবাদ করত এবং অ্যাবেলের কাজ ছিল পশুপালন৷ ওল্ড টেস্টামেন্ট অনুসারে , কেইন খুন করেছিল তার ভাইকে৷ কথিত আছে তাঁদের নাকি এক বোন ছিল আওয়ান৷ আওয়ান প্রেমে পড়ে তার ভাই অ্যাবেলের৷ এদিকে আওয়ানের প্রেমে পড়েছিল কেইন৷ এরপর বোনকে কে পাবে, তা নিয়ে শুরু হয় দ্বন্দ্ব এবং তখন আওয়ানকে পাওয়ার জন্যই ছোটো ভাই অ্যাবেলকে খুন করে কেইন৷ তারপরে সে অ্যাবেলের এই হত্যা নিয়ে খোদ ঈশ্বরের কাছেই মিথ্যা কথা বলে৷ শাস্তি হিসেবে নির্বাসিত হয়েছিল কেইন৷ তবে শোনা যায়, কেইন আর আওয়ানের এক সন্তান হয়েছিল, যার নাম ইনোখ৷
ব্রহ্মা ও সরস্বতী
এদেশে আবার নাকি ব্রহ্মাও কামার্ত হয়ে উঠেছিলেন নিজকন্যা অপরূপা সরস্বতীকে দেখে ৷ সরস্বতী ছিলেন তন্বী , ক্ষীণকটি ও গুরুনিতম্ব সম্বলিত ব্রহ্মার এক অসামান্য সৃষ্টি৷ এদিকে আত্মজা সরস্বতীর সৌন্দর্যে মোহিত হলেন পিতা ব্রহ্মা ৷ স্মৃতিভ্রংশ ঘটল, তাঁর ফলে কামার্ত হয়ে তিনি পিছু নিলেন কন্যার ৷ ছুটে যেতে যেতে আত্মগোপন করতে এক হরিণীর রূপ নিল কন্যা৷ তবু পিছু ছা্ড়ে না পিতা, কন্যাকে দেখবার জন্য হলেন চতুর্মুখ , চাইলেন না মুহূর্তের জন্য তাঁর দৃষ্টিপথের আড়াল হোক কন্যা৷ ফলে কন্যা সরস্বতী যে -দিকেই যান ব্রহ্মাও সে দিকে এগোন৷ তখন পিতার কামার্ত দৃষ্টি এবং ধর্ষণাভিলাষ থেকে বাঁচবার জন্য তিনি নিজেকে উত্ক্ষিপ্ত করেন শূন্যে , ব্রহ্মাও তখন তাঁর মাথার উপর গ্রহণ করেন অন্য এক মুখ এবং হন পঞ্চমুখ৷ সেই সময় অসহায় কন্যা শাপ দেন পিতাকে যে তাঁর এই মুখটি কটুভাষী এবং শিবের হাতে ছিন্ন হবে তাঁর এই পঞ্চম মুণ্ডটি ৷ সেই সময় পুত্রদের দ্বারা তিরস্কৃত হয়ে ব্রহ্মা লজ্জাবশত তাদের সামনেই নিজদেহ ত্যাগ করেন৷ যদিও অন্য পুরাণ অনুসারে, কামপীড়িত পিতার এই দশা দেখে কন্যা সরস্বতী ঘৃণায় ত্যাগ করলেন তাঁর লজ্জা৷ ফলে পিতা নিজশরীর থেকে উৎপন্ন কন্যাতে উপগত হলেন এবং তাঁদের এই মিলন থেকে জন্ম মনু৷ আর গোটা মানবকুল হল মনুর উত্তরাধিকারী৷ অর্থাৎ সৃষ্টির শুরুতেই রয়েছে এক নিষিদ্ধ কর্ম, যা অবশ্য অনুমোদন করেননি বিষ্ণু এবং মহেশ৷ দেববিরোধী এই কর্মের জন্য চিরকালের জন্য অভিশপ্ত হলেন ব্রহ্মা এবং চিহ্নিত হলেন অপূজ্য এক আদি দেবতারূপে৷
যম- যমুনা ঋগ্বেদ জানিয়েছেন , সূর্যের ঔরসে বিশ্বকর্মা কন্যা সরন্যূর গর্ভে জন্ম হয় যমজ সন্তান- যম ও যমী৷ যমীই আবার যমুনা নামে পরিচিত৷ ধরা হয় এরাই পৃথিবীর প্রথম মরণশীল মানব -মানবী৷কামার্তা যমী দ্বীপবর্তী নির্জন স্থানে ভ্রাতা যমের কাছে সহবাসের ইচ্ছা প্রকাশ করে৷ সে জানায়, মাতৃগর্ভে যমজ সন্তান হিসেবে তারা তো ইতিমধ্যেই সহবাসই করেছেন ৷ ফলে বিধাতারই ইচ্ছা তারা যেন শারীরিক ভাবে মিলিত হয়ে সন্তানের জন্ম দেয় ৷ এমনকী যমীর যুক্তি , কেবল মানুষের ক্ষেত্রে এই সংসর্গ নিষিদ্ধ দেবতারা জন্য নয়৷ যদিও যম তাঁকে সতর্ক করে তা প্রত্যাখ্যান করেন৷ তিনি জানান, এমন ভাবে ভগিনীতে উপগত হওয়া পাপের সমান ৷
মাইরা-সিনিরায়
এদিকে গ্রিক পুরানে মাইরা এমন এক নারী , যিনি তাঁর পিতা সিনিরাসের সঙ্গে মিলিত হয়েছিলেন৷ সিনিরাস অবশ্য জানতেন না, তাঁর সঙ্গে মিলন হল যে নারীর , সেই তাঁর কন্যা ৷ কিন্ত্ত যখন তা তিনি জানলেন তখন ক্রুদ্ধ সিনিরাস তরবারি হাতে নিয়ে আক্রমণ করলেন মাইরাকে৷ আর বাবার তাড়া খেয়ে ছুটতে ছুটতে নাকি একেবারে আরবভূমিতে পৌঁছে গেল সেই মেয়ে৷ ইতিমধ্যে ন ’মাস কেটে গিয়েছে ফলে সেই নারী দেবতাদের কাছে প্রার্থনা করলেন৷ দেবতাদের দয়ায় মাইরা গাছে পরিণত হয়৷ সেই অবস্থায় মাইরা জন্ম দিলেন তাঁদের সেই মিলনের সন্তান অ্যাডোনিসের৷ এদিকে দান্তে তাঁর ইনফার্নোয় দেখিয়েছেন , অষ্টম নরকে মাইরা -র আত্মা যে শাস্তি পাচ্ছে , তার কারণ অবশ্য এই অজাচারের জন্য নয়৷ সেখানে আত্মপরিচয় গোপন করাটাকেই অপরাধ হিসেবে গণ্য হয়েছে৷ কারণ তিনি তো আত্মপরিচয় গোপন করে মিলিত হয়েছিলেন তাঁর পিতার সঙ্গে ৷ এই প্রতারণাকে দান্তের ইনফার্নোতে শাস্তির কারণ হিসেবে দেখলেও, ইউরোপের বেশির ভাগ সাহিত্যেই কিন্ত্ত অজাচারকেই শাস্তির কারণ বলে গণ্য করা হয়েছে৷ কারণ অজাচারের মধ্যে দিয়ে মাইরা সামাজিক অনুশাসনকে ভেঙে ফেলেছিলেন বলে মনে করা হয়৷
অয়দিপউস পিতাকে হত্যা করে নিজের মায়ের শয্যা অপবিত্র করবেন অয়দিপউস৷ এমনই অভিশাপ ছিল তাই পরিস্থিতি এড়াতে পিতা পলিবাসের গৃহ ছেড়ে রাজাহীন থিবস নগরীতে হাজির হয়েছিলেন তিনি৷ প্রজারা তখন তাঁকে রাজা হিসেবে বরণ করে নেয়৷ অয়দিপউস বিয়ে করলেন সেই নগরীর রানি, প্রয়াত লাইয়ুসের স্ত্রী যোকাস্তাকে৷ কিন্ত্ত নগরে দুর্যোগ লাগলে , পুরোহিত জানালেন , কারও পাপের ফলে এমন ঘটেছে ৷ পাপীকে খোঁজার শুরু হয়৷ ৷ তখনই জানা যায় লাইয়ুস ও যোকাস্তার সন্তান জন্মানোর সময়েও দৈববাণী হয়েছিল, সন্তান খুন করবে পিতাকে এবং অপবিত্র করবে তার মায়ের শয্যা৷ সে দৈববাণী শুনে যোকাস্তা আদেশ দেন সেই সন্তানকে মেরে ফেলার৷ ভৃত্য মেরে ফেলতে পারেনি শিশুটাকে, দিয়েছিল এক মেষপালককে৷ সেখান থেকে আরও এক হাত ঘুরে সেই সন্তান , অয়দিপউসের ঠাঁই হয় পলিবাসের গৃহে৷ এদিকে অয়দিপউস জেনেছিল দৈববাণীর কথা৷ অপরাধ এড়াতে পিলবাসের গৃহ ছেড়ে রওনা দেয় থিবসের দিকে ৷ তখন এক জন রথে চড়ে এসে তার পথ আটকায়৷ কিন্তু সে পারে না অয়দিপউসের সঙ্গে ৷ ফলে লোকটা মরে অয়দিপউসের হাতে ৷ যদিও ওই লোকটাই যে তার জন্মদাতা পিতা , থিবসের রাজা লাইয়ুস তা জানত না সে ৷ এরপর সে থিবসে এসে বিয়ে করে লাইয়ুসের পত্নী যোকাস্তাকে , যে আসলেতে তার জন্মদাত্রী৷ তাদের মিলনেই জন্মায় চার সন্তান , যারা তাঁর সহোদর -সহোদরাও বটে ৷ যদিও সত্য জানতে পেরে অপরাধবোধে অয়দিপউস মা তথা স্ত্রীয়ের চুলের কাঁটা দিয়ে নিজের চোখ অন্ধ করেছিলেন৷ ‘অয়দিপউস’কে নিয়ে সফোক্লিসের নাটক অবশ্য জগত বিখ্যাত৷

আপনার মতামত দিন:


কলাম এর জনপ্রিয়