ডেস্ক

Published:
2021-05-13 23:52:11 BdST

রংপুর কারুপন্য লিমিটেড গ্রীন ফেক্টরি ,কল্পনা যেখানে বাস্তব


 

ডেস্ক / লেখা সৌজন্য নাজমুস সাকিব
____________________________


প্রায় তিন লাখ বর্গফুটের বিশাল এক কারখানা। সাততলা। ৪০ হাজার বর্গফুট ছড়ানো এক–একটি ফ্লোর। দিনে-রাতে দুই শিফটে এখানে কাজ করেন প্রায় পাঁচ হাজার শ্রমিক। পুরো কারখানায় একটি এসিও নেই, নেই কোনো বৈদ্যুতিক পাখা। অথচ অস্বস্তিকর গরমের দিনেও কোনো শ্রমিক এখানে কাজ করার সময় ঘামেন না। কেননা বাইরের তাপমাত্রার চেয়ে কারখানার ভেতরটা কয়েক ডিগ্রি শীতল।

রংপুর শহরের রবার্টসনগঞ্জে স্থাপিত কারুপণ্য রংপুর লিমিটেডের এই কারখানার ভবন শীতল রাখা হয়েছে এক বিশেষ ধরনের স্থাপত্যকৌশল প্রয়োগ করে। এতে কারখানাটির ৮০ শতাংশ বিদ্যুৎ সাশ্রয় হচ্ছে। কারখানা কর্তৃপক্ষ বলছে, বিদ্যুতের ব্যবহার সর্বনিম্ন পর্যায়ে নামিয়ে এনে একটি সবুজ (গ্রিন) কারখানা গড়ে তোলাই তাদের লক্ষ্য।

কারখানার প্রধান উদ্যোক্তা সফিকুল আলম সেলিম বলেন, কারখানায় শ্রমিকদের কাজ করতে গিয়ে অনেক কষ্ট হয়। বিশেষ করে নারী শ্রমিকদের। তাঁদের মাথার ওপর যতই ফ্যান ঘুরুক, গরমের গুমোট ভাব কাটে না। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতেই ভবন শীতল রাখার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। শ্রমিকেরা এখানে বাড়ির চেয়েও বেশি সাচ্ছন্দ্য বোধ করেন।

শতরঞ্জির হারানো ঐতিহ্যের পুনরুত্থান

কারুপণ্যের এই বিশাল কারখানায় যা তৈরি হয়, তার নাম শতরঞ্জি। এটি রংপুর অঞ্চলের প্রাচীন ঐতিহ্য। একসময় বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া এই শিল্প আবার জেগে উঠেছে। নব্বইয়ের দশকে হাতে গোনা কয়েকজন পুরোনো কারিগরকে সংগঠিত করে নতুন করে এর যাত্রা শুরু করা হয়। ২৮ বছরের দীর্ঘ সময়ে কাঁচামাল, বুনন ও নকশায় নানা পর্যায় পেরিয়ে রংপুরের শতরঞ্জি আজ রপ্তানি হচ্ছে ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা ও এশিয়া মহাদেশের ৫৫টি দেশে। গত অর্থবছরে রপ্তানি ছিল ৩ কোটি ডলার। বর্তমানে বাংলাদেশে হস্তশিল্প রপ্তানি বাণিজ্যে শিল্প খাতে ৮০ শতাংশ রপ্তানি করে থাকে কারুপণ্য। সে জন্য প্রতিষ্ঠানটি ২০০৯ সাল থেকে প্রতিবছরই বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দেওয়া জাতীয় রপ্তানি ট্রফির স্বর্ণপদক পেয়ে আসছে।

এই শতরঞ্জি তৈরির পেছনেও কারখানায় ব্যবহার করা হয় প্রাকৃতিক ও নবায়নকৃত কাঁচামাল। বছরে ৩ হাজার টন কটন মিলের তুলার বর্জ্য থেকে তৈরি হয় সুতা। তা ছাড়া ১ হাজার ২০০ টন গার্মেন্টস ফ্যাক্টরির বর্জ্য ঝুট কাপড় এবং সাড়ে ৪ হাজার টন পাটের আঁশ ব্যবহার করা হচ্ছে এই কারখানায়। বর্জ্য নবায়ন করে পণ্য প্রস্তুত করার ফলে দূষণের হাত থেকে রক্ষা পাচ্ছে পরিবেশ ও প্রকৃতি।

কারুপণ্যের উদ্যোক্তা সফিকুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘সবুজ পরিবেশে শ্রমিকেরা কাজ করলে তাঁদের মনটাও প্রফুল্ল থাকে। উৎপাদনে কোনো ব্যাঘাত সৃষ্টি হয় না। এখানে কাজ করার সূত্রে এ অঞ্চলের পরিবারগুলোতে বেড়েছে নারীর গুরুত্ব। পিছিয়ে থাকা উত্তরবঙ্গের শিল্পায়নে শতরঞ্জি ও কারুপণ্য রংপুর লিমিটেড আজ একটা আস্থার জায়গা বলে আমি মনে করি।’

কারখানার ভেতরে জলাধার

কারখানার স্থাপত্য নকশায় এমন বিশেষ কৌশল প্রয়োগ করা হয়েছে, যাতে কারখানার ভেতরে বাতাস প্রবাহিত হয়। নিচতলায় লবিতে পুকুরের মতো বড় বড় চারটি জলাধার। ১৫ হাজার বর্গফুট ব্যাসার্ধের এ জলাধারগুলো একসঙ্গে ধারণ করতে পারে ৫ লাখ লিটার পানি। আয়রনমুক্ত এই পানি কারখানায় শতরঞ্জি ডাইংয়ের কাজে ব্যবহৃত হয়ে এই জলাধারে আসে।

সবুজ গাছপালা আর এই পানির ওপর দিয়ে উড়ে আসা বাতাস ৩৭ ফুট ব্যাসার্ধের চারটি চক্রাকার শূন্য স্তম্ভের মধ্য দিয়ে প্রবেশ করে কারখানার ভেতরে। তারপর বিভিন্ন তলায় উঠে যায়। ফলে এসি বা ফ্যান ছাড়াই কারখানার বাইরের চেয়ে ভেতরের তাপমাত্রা ৪ থেকে ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস কমে যায়।

কারখানার নকশা প্রণয়নকারী স্থপতি বায়েজিদ মাহবুব খন্দকার বলেন, এই শীতলীকরণপ্রক্রিয়ায় গ্রামবাংলার লোকজ জ্ঞানই প্রয়োগ করা হয়েছে। গ্রামাঞ্চলে ভিটেবাড়ির দক্ষিণ দিকটি খোলা রাখা হয় এবং সেদিকে একটি পুকুর থাকে। গরমকালে পুকুরের ওপর দিয়ে বাতাস শীতল হয়ে এসে বাড়িতে প্রবেশ করে বেরিয়ে যায়।

স্থপতি বলেন, প্রাকৃতিক নিয়ম অনুযায়ী গরম বাতাস ওপরে ওঠে। আর শীতল বাতাস নিচে পড়ে থাকে। এই গরম বাতাস ছাদের ওপর চিমনির ভেতর দিয়ে বেরিয়ে যায়। ফলে পুরো ভবন শীতল হয়ে আসে। কারও জ্বর হলে যেমন কপালে জলপট্টি দেওয়া হয়, কারখানাটিতেও সে রকম জলপট্টি দেওয়া হয়েছে বলা চলে।

বুননকাজে কর্মরত শ্রমিক রেখা পারভীন (২৫) বলেন, যত গরমই হোক, কারখানায় শরীর ঘামে না।

কর্মকর্তারা বলেন, বৈদ্যুতিক পাখা কিংবা এসি না থাকায় কারখানায় ৮০ শতাংশ বিদ্যুৎ সাশ্রয় হয়।

বাগানবাড়ির মতো কারখানা

গেট দিয়ে ঢুকলে আট লাখ বর্গফুটের বিশাল কারখানার চৌহদ্দি। মাঝখানে সাততলা কারখানা ভবন দেখলে একটা বিশাল সবুজ বাগান বললে ভুল হবে না। নানা প্রজাতির গাছে ছেয়ে আছে ইট-পাথরের দালান। সাততলা ভবনের ওপর থেকে দেয়ালজুড়ে ঝুলছে লতাপাতার গাছ। ভবনের সামনেও গাছগাছালি। দক্ষিণের বাতাস এসে গাছে দোল খায়।

এভাবে দেয়ালগুলো গাছে ছেয়ে ফেলাও ভবন শীতল রাখার কৌশলের অংশ। কারখানার কর্মকর্তারা বলেন, ভবনের দক্ষিণ দিকের দেয়ালে সূর্যের আলো এসে পড়ে। সূর্যের তাপ কারখানার দেয়ালে পড়ে এর প্রভাব যেন ভেতরে না যায় এ জন্য ভবনের প্রতি তলায় সাড়ে চার ফুট দূরত্ব রেখে বারান্দা ও জানালা রয়েছে। সেই সঙ্গে বাইরে দেয়ালজুড়ে লাগানো হয়েছে সবুজ লতাপাতা গাছ। এ কারণে রোদের তাপ ভেতরে ঢুকতে পারে না।

এ ছাড়া কারখানার দক্ষিণে সবুজ গাছগাছালি লাগানো রয়েছে। এই গাছে এসে দক্ষিণের গরম বাতাস বাধা পায়। ঘুরপাক খেতে খেতে কারখানার দেয়ালে গিয়ে গরম হাওয়া আরও শীতল হয়ে যায়।

মেঝে ফুটো ও উচ্চতা

কারখানার কর্মকর্তারা বলেন, সাধারণত ভবনের মেঝে থেকে ছাদের উচ্চতা ১০ ফুট হয়। কিন্তু এখানকার প্রতিটি তলার মেঝে থেকে ছাদের উচ্চতা রয়েছে ১২ ফুট। এতে গরম কিছুটা কম অনুভব হবে। এ ছাড়া কারখানার প্রতি তলায় মেঝের মধ্যে যন্ত্র চালানোর ফলে গরম বাতাস বের হয়, সেই বাতাসও যেন ঘরের ভেতর ঘুরপাক না খায় এ জন্য মেঝের মধ্যে প্রতিটি যন্ত্রের নিচে ফুটো রয়েছে। মেঝের মধ্যে এসব ফুটো দিয়ে গরম বাতাস একটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে জানালার ওপরের ঘুলঘুলির মধ্য দিয়ে বের হয়ে যায়।

আপনার মতামত দিন:


কলাম এর জনপ্রিয়