ডেস্ক

Published:
2021-05-14 20:23:23 BdST

একালের " ডিজিটাল ইদ " এবং সেকালের ইদ


 

ডাঃ সুকুমার সুর রায়
___________________________


১৫ বছর আগের এক ঈদুল ফিতরের কথা।
হাসপাতালে ডিউটিতে ছিলাম। অবশ্য চাকুরী জীবনের সব ঈদেই হাসপাতালে জরুরি ডিউটিতে থাকা ছিলো একদম কমন ফেনোমেনা।
যাইহোক, বেলা ১২টার দিকে হাসপাতালের পাশের বাড়ির অত্যন্ত অতিথি পরায়ণ পান্না ভাই ফোন দিয়ে বললেন - " দাদা আপনাদের তো খাওয়ার ব্যবস্থা নাই, আমার বাসায় এসে দুপুরে দুটি ডাল ভাত খেয়ে যাবেন। " আমি বললাম না ভাই, হাসপাতালের সুইপার গুরুচরন রোগীর খাবারের সাথে আমাদের ডিউটিরত ৪ জনের জন্যও পোলাও মাংস রান্না করবে তাই খাবারের কোন সমস্যা নাই। তাছাড়া হাসপাতাল অরক্ষিত রেখে দাওয়াত খেতে যাওয়া কোন বুদ্ধিমানের কাজ নয়।
একটা বিষয় প্রনিধান যোগ্য রোগি ও রোগীর লোকজনের মানসিকতা এইরকম যে তারা মনে করে ডাক্তার কখনো অসুস্থ হতে পারে না। একবার জ্বর নিয়ে বাথরুমে মাথায় জল ঢালা হচ্ছিলো এইসময় রোগী এলো।
"ডাক্তার অসুস্থ, একটু অপেক্ষা করেন " এই কথা বলায় রোগীর লোকজনেরা বলে উঠলো - " ডাক্তারের কখনো অসুখ হয়! এইটা কোন কথা বললেন! ডাক দেন। "
একবার ক্লান্ত হয়ে অনেক রাতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। সেই সময় রাত ৩ টায় রোগী এলো।
গুরুচরন বলেছিলো - " স্যার, কেবলই ঘুমিয়েছে, বিছানার চাদর বিছিয়ে দিচ্ছি রোগিকে শোয়ায়ে দেন, তারপর স্যারকে ডেকে তুলি। "
এর জবাবে রোগির লোক বললো - " এইডা কোন কথা হইলো? আমার রুগি মইর‍্যা যায়! আর ডাক্তার আরাম কইর‍্যা ঘুমাইতেছে!, আগে ডাক্তাররে ডাইক্যা তোলেন। "
আবার খাবার কথা বললে কিঞ্চিৎ ছাড় পাওয়া যায়। যেমন যদি বলা হয় " ডাক্তার সাহেব খাচ্ছে, একটু বসেন। "
তখন রোগীর লোকজনেরা একটু ধৈর্য ধারণ করে বসে থাকে।
এতো সব কথা বলার পরে পান্না ভাই বললেন যে, " ঠিক আছে, খেতে বসার কথা বলে এসেই খেয়ে যাইয়েন। "

আমার বন্ধু ডাক্তার মোহাম্মদ আলির মামি রুনু ভাইয়ের মা দুপুরে ফোন দিলেন।
" ভাগ্নে কোথায়? "
' মামি, আমিতো হাসপাতালে। "
" তাতো জানিই ঈদের দিনে হাসপাতালে ডিউটি করো। এখন আসার দরকার নাই, রাতের বেলায় মামির বাড়ি আইস্যা দুইডা ডাল ভাত খাইয়া যাইয়ো। আমার বাড়িতে কিন্তু গরুর গোশতো ওঠে না ভাগ্নে, কাজেই কোন চিন্তা কইরো না। "
আমি বললাম " কি যে বলেন মামি, গরুর মাংস থাকলেও কোন সমস্যা নাই, আমিতো খাবো ডাল ভাত। "
রাহেলা মেডিকেলের দুলাল ভাই ফোন দিয়ে বললো " দাদা, রাতে খাসির মাংস পোলাওয়ের আয়োজন আছে ; মা আপনাকে অবশ্যই আসতে বলেছে। "
ফোন কাটতে কাটতেই দুলাল ভাইয়ের বন্ধু সাজ্জাদ ফোন দিয়ে বললো - " দাদা, আপনার জন্য আলাদা মুরগির ঝাল মাংসের ব্যবস্থা আছে অবশ্যই আসা লাগবে। "
তাদের দুইজনকেই বললাম, " ভাই, রাতে আমার মামি মানে রুনু ভাইয়ের মাকে কথা দিয়েছি, সেখানে ডাল ভাত খেতে হবে। তবে আপনাদের দুইজনের বাসাতেই যাবো। একজনের বাসায় একটুকরো খাসির মাংস আরেকজনের বাসায় একটুকরো ঝাল মুরগির মাংস খেয়ে দ্রুতই হাসপাতালে ফিরে আসতে হবে। বুঝতেই পারছেন ঈদের রাতে হাসপাতালে যে রোগিরা আসে তারা সাধারণত খুবই জরুরি রোগী হয়!।
১৫ বছরের ব্যবধানে ঈদ ও সামাজিক ব্যবস্থা কি অনেক খানি পরিবর্তন হয়ে গেছে!?
আজ ঈদুল ফিতরের দিন প্রায় পার হয়ে গেলো। একজন মানুষও ফোন করে খোঁজ খবর নিলো না। কেউ শুভেচছাও জানালো না। ডাল ভাত, পোলাও, খাসির মাংস, ঝাল মুরগির মাংস খাওয়ার দাওয়াত এখনো পাওয়া গেলো না।
অবশ্য দুই বছর হলো করোনা মহামারি আমাদের সব কিছু ওলট পালট করে দিয়েছে। অর্থনৈতিক ও সামাজিক ব্যবস্থাকে একদম আমুল পালটে দিয়েছে।
যেখানে স্বাস্থ্য বিধি মেনে, সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে চিরাচরিত ঈদগাহ ময়দানে ঈদের নামাজ আদায় না করে বিকল্প ব্যবস্থা নিতে হচ্ছে; ঐতিহ্যবাহী কোলাকুলি নাই,হ্যান্ড শেক নাই, এবাড়ি ওবাড়ি যাওয়া নাই! আর আমি কিনা নির্লজ্জের মতো দাওয়াত খেতে চাইছি!?
ছি! ছি! ছি!
না, এতো ছি! ছিই! বা করছি কেন?
করোনা তো বছর দুইয়েকের ব্যাপার। এর আগে থেকেই তো কেমন যেন একটা সামাজিক ছাড়া ছাড়া ভাবের সূচনা হয়েছে!
নাকি বছর তিনেক আগে আমার চাকরি থেকে অবসর নেওয়া হয়ে গেছে, বৃদ্ধ হয়ে গেছি ; সংসারে এবং সমাজে অপাংতেয় হয়ে গেছি! মূল্যহীন হয়ে গেছি, এই কারনে শুধু আমার ব্যাক্তিগত ক্ষেত্রে এমনটি ঘটছে!?
নাকি সমাজের ভিতরেই ধীর গতিতে একটা পরিবর্তন হয়ে চলেছে!?

ঈদের দুই দিন আগে থেকে শুরু হয়ে আজ ঈদের দিন সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত মোবাইল ফোন হাতে নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রবেশ করতেই হিমশিম খেতে হচ্ছে!
চারিদিক থেকে সমানে শুভেচ্ছা জানিয়ে মেসেজ আসছে। সেই মেসেজগুলি টেক্সট মেসেজ নয়। ৯০% ইমুজি মেসেজ!!
হাতের ছোঁয়ায় লেখার কোন প্রশ্ন নাই। একটু ফোন করে স্বকন্ঠে দুইটি কথা বলার ফুরসত তাদের নাই। যোগাযোগ মাধ্যম কোম্পানি গুলির বানিজ্যিক ভাবে তৈরি করা প্রানহীন অর্থহীন বিকৃত ছবি ও লেখার মেসেজ সমানে গুঁতোগুঁতি করে পাঠানো হচ্ছে এর থেকে তার টাইমলাইনে, তার থেকে ওর টাইমলাইনে!
তার মধ্যে আবার রাজনৈতিক নেতা নেত্রীরা বড় নেতা থেকে পাতি নেতার ছবি উপর থেকে নীচে পর্যন্ত সাঁটিয়ে দিয়ে নানান ভঙ্গীমার ফ্রেমে সমানে পাঠিয়ে দিচ্ছে সামান্য শুভেচ্ছা জানিয়ে। বিভিন্ন কোম্পানির লোকেরা, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের লোকেরা একই কাজ করছে সমানে গুঁতোগুঁতি করে।
এমন ব্যাপক গুঁতোগুঁতি চলছে যে, নেটওয়ার্ক ফেইল মারার উপক্রম হয়েছে!
তাহলে কী আমাদের সেই রুনু ভাইয়ের মায়েরা হারিয়ে যাচ্ছে!
তা হলে কি দ্রুত গতিতে উত্থান হচ্ছে প্রানহীন, দরদহীন, সামাজিক দায়বদ্ধতাহীন, এক নিষ্ঠুর কাল্পনিক ডিজিটাল সমাজ!?
সেই ভবিষ্যত সমাজের শুরু দেখতে পাচ্ছি এই 'ডিজিটাল ঈদ ' উদযাপনের মধ্য দিয়ে!!??
তবে তাই হোক! এই ডিজিটাল ঈদে সাবাইকে জানাই - " ডিজিটাল ঈদ মুবারক। । "

-- ডাঃ সুকুমার সুর রায়।।

( বিঃ দ্রঃ_ এই লেখা পড়ার পর কেউ আবার আমাকে ' মাটন পোলাও ' এর দাওয়াত দিয়ে বসবেন না। কারন হার্টের কারনে সেগুলি খাওয়াও নিষেধ হয়ে গেছে।)।।।

আপনার মতামত দিন:


কলাম এর জনপ্রিয়