ডেস্ক

Published:
2021-05-23 15:55:06 BdST

'যাই একটু ঘুরে আসি, পরীক্ষা -নিরীক্ষা করতে হলে দুয়েক দিন থাকতে হতে পারে, চিন্তা কোরোনা, আল্লাহ ভরসা!’


 

ডেস্ক
_______________

অধ্যাপক ডাঃ মোঃ নুরুল ইসলাম স্যার ছিলেন ফরেনসিক মেডিসিন এর পথিকৃৎ। তাঁকে নিয়ে স্মৃতি শ্রদ্ধা এপিটাফ লিখেছেন প্রখ্যাত চিকিৎসক অধ্যাপক ডা মোজাহেরুল হক, ডাঃ মোঃ নুরুল ইসলামের কন্যা জেবুননেসা রায়হান এবং সিএমসি২৮ এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোরোগ বিদ্যা বিভাগের প্রফেসর ডা সুলতানা আলগিন।


'যাই একটু ঘুরে আসি, পরীক্ষা -নিরীক্ষা করতে হলে দুয়েক দিন থাকতে হতে পারে, চিন্তা কোরোনা, আল্লাহ ভরসা’! —এই ছিল আম্মার সাথে আব্বার শেষ কথা।কথা দিয়ে কথা রাখেননি, আর ফিরে আসেন নি।এসে ছিলেন তবে সে শুধু তাঁর দেহখানি, কাফনের সাদা কাপড়ে জড়ানো নিষ্প্রাণ দেহ। শরীর খুব খারাপ নিজে ডাক্তার হয়ে ঠিকই বুঝেছিলেন আর তাই তো বাসার গাড়িতে না গিয়ে এ্যাম্বুলেন্স আনিয়েছিলে, গাড়িতে বসে যেতে পারবেন না তাই। আমার সহজ সরল মা কিছুই বুঝতে পারেননি, বুঝতে দেওয়াও হয়নি তাঁকে।হাসপাতালে যে কয়দিন ছিলেন জাউভাত আর সুজির পাতলা হালুয়া খেতেন আর তা আম্মা বানিয়ে পাঠাতেন। উপর দিয়ে ভালোই মনে হয়েছিল, মেসওয়াক দিয়ে দাঁত মেজে অজু করতেন প্রতিবেলা, হাসপাতালেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। ভাইদের সাথে অনেক কথা বলেছেন, আকারে ইঙ্গিতে অনেক কিছু বোঝাবার চেষ্টা করেছিলেন, বলেছিলেন, ’সবাই মিলে মিশে থাকবে, সৎ পথে চলবে, কান্নাকাটি করবে না কোনো ব্যাপারেই, ধৈর্য্যের সাথে, ঈমানের সাথে চলবে’।সরাসরি বলেন নি যে তিনি আর ৩/৪ দিনের অতিথি মাত্র। ১৯৯২এর মে মাসের আজকের দিনের দুপুর ঠিক আড়াইটায় আমাদের সবার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই চলে গেলেন নিঃশব্দে! কোনো রকম কষ্ট ছাড়া,একটু চোখ বড় করে তাকিয়েছিলেন শুধু শেষবার। মারা যাওয়ার দু’ঘণ্টা আগে নিজের সব রিপোর্ট নিজেই দেখেছেন।কী অপরিসীম মনের আর ঈমানের জোর!
আমরা বড় তিন ভাইবোন ছাড়া বাকিরা সবাই ছোট, শুধু আমাদের দু’বোনকে বিয়ে দিয়েছিলেন খুব তাড়া তাড়ি আঠারো বছরে, ইন্টার পাশের সাথে সাথে আর অসম্ভব ভাল দু’জামাতাকে অভিভাবক হিসেবে রেখে পরপারে পাড়ি জমালেন। একবারের জন্যেও বলেন নি কাউ কে যে আমার ছেলেমেয়েদের দেখো, আল্লাহর উপরই ভরশা করেছিলেন।
বড় অসময়ে চলে গেলেন সব কাজ অসমাপ্ত রেখে।
এই আমার বাবা অধ্যাপক ডাঃ মোঃ নুরুল ইসলাম। উনি চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ছিলেন। সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার স্বার্থে ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের উন্নয়ন একটা অতি জরুরী বিষয়। উনি এই বিভাগের দায়িত্ব নেওয়ার আগে এদেশে চিকিৎসা বিজ্ঞানের এ শাখাটি অত্যন্ত অনুন্নত ও অবহেলিত ছিল। তাঁর অক্লান্ত চেষ্টা এবং পরিশ্রমের ফলে দেশের বিভিন্ন মেডিকেল কলেজে ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগ একটি পূর্ণাঙ্গ বিভাগে পরিণত হয়।ফরেনসিক মেডিসিনের পাঠ্যক্রম আধুনিকায়ন এবং এ বিষয়ে স্নাতকোত্তর শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ তাঁরই অদম্য উৎসাহ ও চেষ্টার ফল।ব্যবহারিক জীবনে একজন চিকিৎসকের জন্য ফরেনসিক মেডিসিন যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়, এদেশের চিকিৎসক সমাজের মাঝে তিনিই প্রথম এই উপলব্ধি সৃষ্টি করেছিলেন। তিনিই ছিলেন এদেশের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের জনক এবং স্বপ্নদ্রষ্টা। তাঁকে যে এ দেশের ফরেনসিক মেডিসিনের জনক বলা হয়, সে কথাটাও মনে হয় শুনে যেতে পারেন নি।রোগীঅন্ত প্রাণ ছিল তাঁর। প্রতিদিন গভীর রাত পর্যন্ত রোগী দেখতেন।অনেক রোগী দেখতেন বলে ভাল করে না দেখে তাড়াহুড়া করে ব্যবস্থাপত্র দিয়েছেন -এধরণের অভিযোগ কখনও শুনা যায়নি। গভীর মমতা ও যত্নের সাথে রোগী দেখতেন উনি অনেক সময় ধরে। আগে ওদের কথা শুনে নিতেন। দুর-দূরান্তের গরীব রোগীর সংখ্যাই থাকতো বেশি। কেউকেই ফিরিয়ে দিতেন না, যাদের সামর্থ্য নাই ওষুধ-পথ্য কেনার তাও কিনে দিতেন। বেশি রাত হয়ে গেলে তাদের হোটেলে থাকার ব্যবস্থা করে দিতেন।আব্বার চেম্বারকে ঘিরে অনেক খাওয়ার, ওষুধের, চায়ের দোকান গড়ে উঠেছিল, যতক্ষণ চেম্বার খোলা থাকত সেসব দোকানপাটও খোলা থাকত ততোক্ষণ। প্রায় মধ্যরাত পর্যন্ত রোগী দেখে সেই কষ্টার্জিত আয়ের সামান্য অংশটুকুও রাখতেন না নিজের জন্য বা পরিবারের জন্য। দু’হাতে বিলিয়ে দিতেন তা দেশের বিভিন্ন মসজিদ -মাদ্রাসা, এতিমখানা ও গরীব দুঃখীদের মাঝে। সারাজীবন পড়ার খরচ চালিয়েছেন অসংখ্য দরিদ্র ছেলেমেয়ের।রোগী হিসেবে তাঁর চেম্বারে আগত গরীব-দুখী, ছাত্র- শিক্ষক, প্রতিবেশী বা তাঁর চেনা জানা মানুষের থেকে তিনি কখনই ফি নিতেন না। মেডিক্যালের কত ছাত্র- ছাত্রীর পড়ার খরচ চালাতেন তা কেউ জানতো না।আমরা জেনেছি উনি মারা যাওয়ার পরে তার প্রিয় ছাত্র-ছাত্রীদের কাছ থেকেই। রাতদুপুর পর্যন্ত রোগী দেখেও ওনার ব্যাংক-ব্যালেন্স কিছুই ছিল না। মারা যাওয়ার সময় ওনার ব্যাংকে পাওয়া যায় মাত্র সাত হাজার টাকা। আমার মাকে অসহায় বোবা দৃষ্টিতে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকতে দেখেছি মৃত বাবার দিকে। শোকে-দুঃখে একেবারে পাথর হয়ে গিয়েছিলেন তবে ভেঙ্গে পড়েননি। আল্লার উপর ভরশা করেই জীবনের বাকিটা পথে একাই যাত্রা করেছিলেন সাথী হিসেবে ছিল জামাইরূপী দুই ছেলে। সম্বল ছিল প্রফিডেণ্ট ফাণ্ডের টাকা। আল্লাহর উপর ভরশা করে বাকি তিন মেয়ের আর তিন ছেলের পড়াশোনা করিয়েছেন, বিয়ে দিয়েছেন, ছোট একটা একতলা বাড়ি করেছিলেন তবে বেশিদিন থাকতে পারেন নাই।কিডনীর সমস্যার জন্য ডায়ালাইসিস করতে হতো সপ্তায় দু’দিন। তিনবছরের মাথায় আব্বা মারা যাওয়ার প্রায় ২১বছর পর উনিও গিয়ে আব্বার সঙ্গী হন।
আজ কতগুলো দিন পার হলো বাবা-মাকে ছাড়া!একসময় মনে হতো বাবা-মা না থাকলে বাঁচবোই না!কিন্তু বেঁচে আছি,সব কিছুই নিয়ম মাফিক চলছে, কোনো কিছুই থেমে নেই, থেমে গেছে শুধু মা-বাবার স্নেহের হাতের পরশ!
আজ ২৯ বছর শেষ হলো আব্বা আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন।মনে হয় এই তো সেদিন আমরো সব ভাইবোন আর আম্মা তাঁর হাসপাতালের বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে দোয়া পড়ছি,আল্লাহকে বলছি ,’আল্লাহ্!আমার বাবার হায়াত দাও, এত তাড়াতাড়ি তাকে নিও না আমাদের এতিম করে’!আল্লার হয়তো এর বিনিময়ে অনেক বড় কোনো নেয়ামত রেখেছেন ওনার জন্য বা অনেক কষ্ট থেকে ওনাকে বাঁচিয়ে দিয়েছেন।মাত্র সাতান্নো বছর হায়াত পেয়েছিলেন তিনি।এই অল্প সময়ে অনেক নেক কাজ করে গেছেন।অনেক কাজ অসমাপ্ত ছিল।ফরেনসিক মেডিসিনের উপর একটি বই লিখছিলেন, তার জন্য অনেক পড়াশোনা করতেন, অনেক বই ছিল, নিজের অনেক বছরের অভিজ্ঞতার আলোকে অনেক খানি লিখেওছিলেন কিন্তু শেষ করতে পারেননি।
আজ ওনার মৃত্যবার্ষিকী।দেখতে দেখতে কখন ঊনত্রিশ বছর পার হয়ে গেল!এখন আমাদের কাছে একটাই চাওয়া ওনার, ওনার জন্য দু’হাত তুলে আল্লাহর কাছে দোয়া চাওয়া! আল্লাহপাক যেন ওনার বারযাখী জীবনে ওনাকে ভাল রাখেন,ওনার কবরকে কেয়ামত পর্যন্ত জান্নাতের সাথে সংযোগ করে দিন,শেষ বিচারের পরে জান্নাতের সবচেয়ে উঁচু মাকামে স্থান দিন ইয়া রব্বুল আ’লামীন!

২১ মে লেখা। 
( শ্রদ্ধেয় স্যারের কন্যা Zebun Nessa Raihan এর ওয়াল থেকে নেয়া)

অধ্যাপক ডা মোজাহেরুল হক লিখেছেন, বাংলাদেশের ফরেনসিক মেডিসিন এর আজকের এই অবস্থান যার অবদান। মেডিকোলিগেল সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ও প্রথম অধ্যাপক । যার অনুপ্রেরণায় আজকের আমি। প্রতি ওয়াক্ত নামাজান্তে আমার মা বাবার জন্য ও যার জন্য আমার দোয়া তিনি প্র: নূরুল ইসলাম। আপনারাও তার জন্য দোয়া করবেন। আল্লাহ্ তাকে জান্নাতুল ফেরদৌস নসীব করবেন ইনশা আল্লাহ্ ।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোরোগ বিদ্যা বিভাগের প্রফেসর ডা সুলতানা আলগিন এক শ্রদ্ধা এপিটাফ এ জানান,  নুরুল ইসলাম স্যার সিএমসির কিংবদন্তি। ছিলেন ভালো মানুষ।  ছিলেন ধর্ম ভীরু। ছিলেন কিংবদন্তি সময় শিক্ষক। ছিলেন পিতার সময় স্নেহময়, স্নেহশীল। 

সিএমসি, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীরা আমরা স্যারকে ভুলবো না। 

আপনার মতামত দিন:


কলাম এর জনপ্রিয়